মহানবী (স.) এর ১৩ বছরের ছোট হযরত ওমর ৫৮৩ খ্রিস্টাব্দে মক্কার কুরাইস বংশের আদিয়া গোএের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জম্নগ্রহন করেন। তাঁর চল বা ডাক নাম ছিল হফস। পিতার নাম ছিল খাওাব এবং মায়ের নাম ছিল খানতামা। শ্যামলা ও দীর্ঘকায় ওমর খুব শক্তিশালী,তেজস্বী,বীর পুরুষ হিসেবে খ্যাতি অজন করেন। তিনি একাধারে ছিলেন কুস্তিগিরি, বাগ্মী ও কবি। ঐতিহাসিক বালাজুরীর মতে, জাহেলিয়া যুগে কুরাইশ বংশের মাএ ১৭ জন শিক্ষিত ব্যাক্তির মধ্য হয়রত ওমর ছিলেন অন্যতম। সফল ব্যাবসায়ী হিসাবে তাঁর সুনাম ছিল এবং ব্যাবসার কারনে তিনি সিরিয়া ও পারস্য ভ্রমন করেন।
হযরত ওমর প্রথম জীবনে ইসলামের ঘোর বিরোধী হলেও ৬১৬ খ্রিস্টাব্দে নবী করীমের নিকট ৩৩ বৎসর বয়সে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেন। জানা যায়, তার ইসলাম গ্রহণের জন্য রাসূল (সা:) স্বয়ং আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন। তাঁর ইসলাম ধর্ম গ্রহণে ইসলামের ইতিহাসে এক গৌরোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা হয়। ইসলাম গ্রহনের পর নবী করীম (স.) হযরত ওমর কে “ফারুক” উপাধিতে ভূষিত করে সম্মানিত করেন।
তার জীবনের শুরুতে ওমর (রা.) ইসলামের ঘোর শক্র থাকা অবস্থায় তিনি নও মুসলিমদের সাথে খুবই খারাপ ব্যাবহার ও তাঁদের নির্যাতন করতেন৷ জানা যায়, বাড়ির চাকরানি ইসলাম ধর্ম গ্রহন করাই তিনি তাঁর ওপর অসহনীয় নির্যাতন করেন৷ এমনকি তিনি মহানবীর প্রতি এতটাই ক্ষিপ্ত ছিলেন যে, একদিন তিনি তাঁর খোলা তলোয়ার হাতে নিয়ে মহানবী (সা.) কে হত্যা করার উদ্দেশে রওয়ানা দেয়।
পথিমধ্যে নঈম বিন আব্দলা নামক জনৈক ব্যক্তির সাথে তার সাঙ্গাৎ হয়। নঈম তাঁকে জিঙ্গাসা করলেন, তুমি কোথায় যাচ্ছ? ওমর (রা.) উত্তরে বলেন, মুহাম্মদ কে হত্যা করতে যাচ্ছি। নঈম বলেন, আগে তোমার নিজের ঘরে গিয়ে দেখ স্বয়ং তোমার ভগ্নিপতি ইসলাম গ্রহন করেছে। একথা শুনে রাগে অগ্নিশরমা হয়ে তিনি ভগ্নিপতি বাড়ির দিকে রওনা হন।
ওমর (রা.) এর আগমনের খবর পেয়ে তাঁর ভাগ্নিপতি ও তার স্ত্রী কুরআন শরীফের যে অংশটুকু সূরা “তা-হা” পাঠ করতে ছিলেন তা লুকিয়ে রাখেন। ওমর( রা.) জানতে চাইলেন যে, তাঁরা তাদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণের কথা সত্য কিনা। জবাবে তারা জানায়, তাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেছে। এতে অত্যাধিক ক্ষিপ্ত হয়ে ওমর (রা.) তাঁদের উপর নির্মমভাবে নির্যাতন করতে লাগলো, কিন্তু তাতে কোন ফল হয় নি। তাঁরা তাঁদের সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন।
হযরত উমর বাড়িতে প্রবেশের আগে শুনতে পেয়েছিলেন তারা কিছু পড়ছে। হটাৎ তিনি বলেন, আমি এখানে প্রবেশের পূর্বে তোমরা যা পড়ছিলে তা নিয়ে আসো তো দেখি। প্রথমে আনতে না চাইলেও পরে তার ভগ্নীপতি তার কাছে কোরআন শরীফ নিয়ে আসেন।
তার কাছে কোরআন শরীফ দেবার পর তিনি সেখান থেকে পড়তে থাকেন। কোরআন কিছুটা পড়ে তিনি অত্যন্ত মুগ্ধ হয়ে যান। তিনি বুঝতে পারেন যে, আর যাইহোক এই কোরআন শরীফ কোন মানুষের লেখা হতে পারেনা। অতঃপর তিনি সেখান থেকে উঠে তরবারি নিয়ে রওনা দেন রাসূল (সা:) এর উদ্দেশে।
হযরত ওমর এর আসার সংবাদ পেয়ে সাহাবীরা রাসূল (সা:) কে রক্ষা করার জন্য একত্রিত হোন। ওমর রাসূল (সা:) এর পায়ের কাছে তরবারি রেখে তিনি তাকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করার জন্য রাসূল (সা:) কে অনুরোধ করেন। অতঃপর রাসূল (সা:) তাকে শাহাদাত পাঠ করিয়ে ইসলামে বরণ করে নেন। এভাবে হযরত ওমর (রা.) নবুয়াতের ষষ্ঠ বৎসরে ৩৩ বৎসর বয়সে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেন। ইসলাম ধর্ম গ্রহন করার পর রাসূল (সা.) তাঁকে “ফারুক” অথাৎ সত্য মিথ্যার প্রভেদকারী উপাধিতে ভূষিত করেন।
ওমর (রা) এর ইসলাম গ্রহণের ফলে মুসলমানগন অনেক শক্তিশালী হয় এবং ওমর (রা.) এর তেজস্বিতার কারণে কাফের গণ ভীত হয়ে পরে। আর এ সুযোগে মুসলমানগন প্রকাশ্যে নব উদ্যমে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। মহানবীর আদেশে তিনি বিশ জন মুসলমান কে নিয়ে মদিনায় হিজরত করেন। মদিনাতে মহানবী যখন নামাজের জন্য কিভাবে আহ্বান করা হবে তা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন, তখন ওমর ফারুকই আজান দ্বারা নামাজের আহ্বান সংকেত প্রচলন করার পরামর্শ দান করেন। যা পরবর্তী কালে ঐশীবানী দ্বারা অনুমোদিত হয়। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) খোদার হুকুমে সে পরামর্শ গ্রহণ করেন এবং হযরত বেলালকে প্রথম মুয়াজ্জিন হিসেবে নিযুক্ত করেন।
মদিনায় হিজরত এর পর কুরাইসগন যখন মদিনা আক্রমণ করে তখন বদর প্রাপ্তরের যুদ্ধ ওমর মুসলমানদের পতাকার ছায়াতলে যুদ্ধ করেন। ওহুদের যুদ্ধে মহানবীর জীবন রক্ষার জন্য ঢাল হয়ে দাঁড়ান। রাসূল (সাঃ) জীবিত থাকা অবস্থায় এভাবেই প্রতিটি যুদ্ধে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ও রাসূল (সা:) এর জীবনে রক্ষার জন্য নিজ বুক পেতে দেন ।
হযরত উমর এর দুরুদর্শিতা, ঈমান, আখলাক, প্রজ্ঞা এমনি ছিল যে মহানবীর (সা:) বলেছিলেন, তার পরে কেউ নবী হলে সে হত হযরত ওমর (রা:) আনহু। রাসূল (সা:) এর মৃত্যুর পর যখন মুসলিমদের মাঝে বিষ্মৃঙ্খলা দেখা দেয় তখন হযরত ওমর খোলা তরবারী হাতে নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখনই আর্থিক তহবিল করার কথা বলতেন তখনই হযরত ওমর দানের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতেন। হযরত উমর ছিলেন শ্রেষ্ট দানশীলদের একজন। তিনি রাসূলের কোষে অসংখ্য স্বর্ণ মুদ্রা দান করেছেন। হযরত উমরের দানশীলতা দেখে অনেক মুসলিম দানের প্রতি আগ্রহী হন ও বেশি বেশি করে দান করতে থাকেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত্যুবরণ করবার পরে যখন মুসলিমদের মাঝে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় তখন তিনি খোলা তরবারী হাতে নিয়ে হুংকার দেন। যার ফলে উদ্ভূত সেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়।
খলিফা হযরত ওমরের দূরদর্শিতার ফলে মুসলিমদের সাম্রাজ্য বৃদ্ধি পেতে থাকে। যা কিনা অন্যন্যা যেকোন সময়ের থেকে বেশি। এভাবেই খলিফা হিসেবে হযরত ওমর তার দূরদর্শিতা, একাগ্রতা, বিচক্ষণতার বলে ইসলামের খেদমত করে গিয়েছেন।
খলিফা হিসেবে হযরত ওমর:
ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হিসেবে হযরত ওমর ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ। তার শাসন আমলে যাবতীয় বিশৃঙ্খলা তিনি কঠোর হস্তে দমন করেন। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা দেয় যে, মদ্য পানের অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হওযায় তিনি তার নিজ সন্তানকে ১০০ বেত্রাঘাত করেন। একজন শাসকদের অসাধারণ চরিত্র ফুটে উঠে এর মাধ্যমে। খলিফা হয়রতের এমন অসাধারণ কঠোরতা তার শাসনামলে সকলের মাঝে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।
পূর্ববর্তী খলিফার তুলনামূলক নমনীয় আচরণের ফলে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা তিনি খুবই সূচারু রূপে সমাধান করেন। তার সময়ে নানা বিদ্রোহ তিনি কঠোর হাতে দমন করেন।
হয়রত ওমরের মৃত্যু:
হযরত ওমর এর খিলাফতকাল ছিলো সর্বমোট ১০ বছর ৬ মাস। হযরত ওমর ফারুক (রা:) হিজরী ২৩ সালে ২৪ যিলহজ্জ্ব তারিখে বুধবার মসজিদে নববীতে ফজরের নামাযে ইমামতি করার জন্য দাড়ালে হযরত মুগিরা ইবনে শোবা (রা:) এর একজন দাস আবু লুলু বিষাক্ত তরবারী দ্বারা হযরত ওমর ফারুক (রা:) কে আঘাত করলে তিনি গুরুতর আহত হয়ে পরেন। পরবর্তীতে আহত অবস্থায় তিন দিন অতিবাহিত হওয়ার পর ২৭ যিলহজ্জ্ব তিনি শাহাদাত বরণ করেন। হযরত ওমর (রা:) কে মসজিদে নববীতে হযরত সিদ্দিকে আকবর (রা:) এর কবরের বামপাশে দাফন সম্পন সম্পন্ন করা হয়।
শেষ কথা: ইসলামের ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত একটি নাম খলিফা হযরত ওমর (রা:)। পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত যার নাম প্রতিটি ঈমানদার মোমিনের অন্তরের আকাশে দীপ্তিমান নক্ষত্রের মতন দীপ্তিমান থাকবে। আর তাইতো, খলিফা হযরত ওমর আমাদের অনুপ্রেরণা, আমাদের আদর্শ।
0 Comments